দাঁত ভেঙ্গে যাওয়া বা ক্র্যাক হলো এমন একটি সমস্যা যেটিতে আঘাত পাওয়ার ফলে দাঁতের কোনো একটি অংশ বা পুরো দাঁত ভেঙ্গে যায়। এটি সব সময় মারাত্মক নাও হতে পারে। যদি খুব সামান্য ক্র্যাক হয় যেটির জন্য চিকিৎসারও প্রয়োজন পরে না। কিন্তু যদি ভেঙ্গে যাওয়া অংশটি থেকে ব্যাথা, রক্তপাত হয় বা সেটি মুখের অন্যান্য অংশের ওপর প্রভাব ফেলে তখন চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া খুব জরুরী।
এই রোগের প্রধান কারণ হলো আঘাত। যেটি কোনো গাড়ি দুর্ঘটনা, পড়ে যাওয়া বা খুব শক্ত কোনো খাবার চেবানোর ফলে হতে পারে। যেহেতু একদম ছোটো বয়সে এবং বয়সকালে দাঁতের গঠন সব থেকে বেশি আলগা হয়, তাই একদম ছোটো ও বয়স্ক দের এই রোগটি হওয়ার সম্ভাবনা সব থেকে বেশি। এছাড়াও ডেন্টাল ফিলিং বা রুট ক্যানাল থেকেও এই সমস্যাটি হতে পারে।
১. দাঁতের চারপাশ ফুলে যাওয়া
২. দাঁতের মধ্যে ব্যাথা বিশেষ করে খাবার খাওয়া বা অন্য কারনে দাঁতে চাপ পড়লে
৩. খুব গরম বা ঠান্ডা খাবার খেলে দাঁতে শিরশিরানি অনুভূতি
৪. মুখের ভেতর দাঁতের ভেঙ্গে যাওয়া অংশ স্পষ্ট দেখতে পাওয়া
দাঁতের ভেঙ্গে যাওয়া অংশটির ওপর সিরামিক বা পোর্সেলিন ক্যাপ ব্যাবহার করে অংশটিকে ঢেকে ফেলা হয়। এছাড়াও চিকিৎসক পলিশিংয়ের মাধ্যমে ভেঙ্গে যাওয়া খাঁজ গুলিকে সমান করে দেন, যাতে সেটি থেকে মুখের ভেতরে পুনরায় কোনো ক্ষত সৃষ্টি না হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্লাস্টিক রেসিন ব্যবহার করা হয় দাঁতের মধ্যে তৈরি হওয়া গর্ত গুলিকে বন্ধ করার জন্য। যদি ভেঙ্গে যাওয়ার পরিমাণ অনেক বেশি হয়, সেক্ষেত্রে পুরো দাঁত টিকেই তুলে ফেলতে হয়। এছাড়াও ব্যাথা ও অন্যান্য উপসম কমানোর জন্য ওষুধের ব্যাবহার বহুল প্রচলিত।
১. বয়স্ক এবং একদম ছোটো দের খুব শক্ত কোনো খাবার না দেওয়া
২. কোনো খেলাধূলার সাথে যুক্ত থাকলে অবশ্যই মাউথ গার্ড ব্যাবহার করা উচিত
৩. নিয়মিত দাঁত ও মাড়ি পরিষ্কার রাখার অভ্যেস গড়ে তোলা
এটি একটি গুরুতর সমস্যা যেটির সময়মতো চিকিৎসা না করালে সম্পূর্ণ দাঁত নষ্ট হয়ে যেতে পারে। দীর্ঘসময় ধরে দাঁতের যত্ন না নেওয়ার ফলে এই রোগটি তৈরি হয়। রোগটি বাড়তে বাড়তে মাড়ির পেশীর মধ্যে গর্ত তৈরি করে ফেলে এবং ক্রমাগত রক্তপাত হয়।
ঠিকভাবে দাঁতের যত্ন না নেওয়া এই রোগটির মূল কারণ। দাঁত পরিষ্কার না রাখলে বা ঠিকভাবে ব্রাশ না করলে মুখের মধ্যে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি বৃদ্ধি পায়। এই ব্যাকটেরিয়া দাঁতের গোড়ায় আস্তরণ তৈরি করে যেটি টার্টার নামে পরিচিত। এই রোগে সব থেকে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে সেই সমস্ত ব্যক্তি যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই কম। এছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্রে শরীরে হরমোনের ব্যালান্স ঠিক না থাকলে সেটি থেকেও এই সমস্যাটির সৃষ্টি হতে পারে।
১.এই রোগের প্রধান লক্ষণ হলো মাড়ি থেকে রক্তপাত এবং তার সাথে তীব্র ব্যাথা
২. দাঁতের মধ্যে হলদে আস্তরণ তৈরি, যা ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে জমে যায়
৩. মাড়ির টিস্যুর মধ্যে ক্ষয় লক্ষ্য করা, যেটিকে পকেট বলা হয়
৪. নিঃশ্বাসের সাথে দুর্গন্ধ বের হওয়া, যা হ্যালিটোসিস নামে পরিচিত
চিকিৎসার প্রথম ধাপে চিকিৎসক আস্তরণ টিকে সরিয়ে ফেলার পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন, যেটি রুট সারফেস ইনস্ট্রুমেন্ট পদ্ধতি নামে পরিচিত। এই পদ্ধতি টি একাধিক বার করতে হতে পারে। এছাড়াও প্রয়োজন অনুযায়ী হাড় ও পেশীর ক্ষয় রোধ করতে চিকিৎসক অস্ত্রপ্রচার করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। রোগের লক্ষণ ও মুখের মধ্যে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা কমতে চিকিৎসক কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ সেবন করতে দিতে পারেন।
১. নিয়মিত ব্রাশ এবং ফ্লসিং এর মাধ্যমে দাঁত পরিষ্কার রাখা এই রোগ থেকে দূরে থাকার সব থেকে কার্যকরী উপায়
২. অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল মাউথ ওয়াশ ব্যাবহার করা যেতে পারে
৩. একবার এই রোগটি হয়ে থাকলে, চিকিৎসার পরেও কয়েক মাস অন্তর চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত
ডেন্টাল ক্যাভিটি বা দাঁতের ক্ষয় হলো দাঁতের মধ্যিখানে গর্ত বা ক্ষত তৈরি। এটি যে কোনো বয়সের মহিলা বা পুরুষ উভয়েরই হতে পারে। এমনকি এটি স্থায়ী দাঁত ও দুধের দাঁত দুটিতেই হতে পারে।
এই রোগটি হওয়ার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো প্রচুর পরিমাণে শর্করা জাতীয় খাবার খাওয়া এবং সেগুলি খাওয়ার পর মুখের ভেতরের অংশ ঠিকভাবে পরিষ্কার না করা।আমাদের দাঁতের মধ্যে যে ব্যাকটেরিয়াগুলি রয়েছে তারা সেই শর্করা গুলিকে খাবার হিসাবে ব্যাবহার করে এবং সেখান থেকে অ্যাসিড উৎপন্ন করে। এই অ্যাসিড দাঁতের জন্য খুবই ক্ষতিকর এবং দাঁতের এনামেলকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করতে থাকে। প্রধানত, স্ট্রেপটোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া এই ক্যাভিটির জন্য দায়ী।
১. এই সমস্যা টি সৃষ্টি হলে কিছু খাওয়ার সময় বা অন্য কারনে দাঁতের ওপর চাপ পড়লে সেটি থেকে ব্যাথা শুরু হয়।
২. দাঁত এবং মাড়ি অত্যধিক সংবেদনশীল হয়ে ওঠে বিশেষ করে ঠান্ডা বা গরম খাবার ও পানীয়র প্রতি
৩. মাড়ি ফুলে ওঠা
৪. রাত্রের দিকে দাঁতে তীব্র ব্যাথা
এই রোগের চিকিৎসা খুবই সহজ এবং একদিনের মধ্যেই রোগী কে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই রোগের চিকিৎসায় ফ্লুরাইডেতেড বার্নিশের ব্যাবহার বহুল প্রচলিত। এছাড়াও যদি সমস্যাটি খুবই গুরুতর হয় সেক্ষেত্রে চিকিৎসক দাঁতের ক্ষয় টি ভরাট করার জন্য ফিলিং ব্যাবহার করে থাকেন। এগুলির পরেও যদি সমস্যাটি ঠিক না হয়, সেক্ষেত্রে দাঁত তুলে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। এগুলো ছাড়াও, ব্যাথা কমানোর জন্য বা সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য চিকিৎসক কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ ব্যাবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
১. শর্করা জাতীয় খাবার খাওয়ার পর ভালো করে মুখের ভেতর পরিষ্কার করা
২. দিনে অন্তত দুবার ব্রাশ করা ফ্লুরাইডেটেড টুথ পেস্ট দিয়ে
৩. মাউথওয়াশ ব্যাবহার করা, যেটি মুখের ভেতর ব্যাকটেরিয়ার অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি কমায়
৪. দাঁতে ব্যাথা বা সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি পেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া
রুট ক্যানাল হলো একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যেটি দাঁত তুলে না ফেলে দাঁতের সমস্যার সমাধান করার জন্য ব্যাবহার করা হয়। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে রুট ক্যানাল ট্রিটমেন্ট টি ঠিক ভাবে কাজ করে না এবং সেটি থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। রুট ক্যানাল ট্রিটমেন্ট টি হওয়ার পর ব্যাথা বা ফোলা ভাব টি থাকা খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু সেটি যদি ২-৩ দিনের মধ্যে না কমে এবং ব্যথার তীব্রতা বাড়তে থাকে, তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে সেটি থেকে সংক্রমন হয়েছে।
রুট ক্যানাল সংক্রমণ টি কমই দেখা যায়। এটির প্রধান কারণ ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি, যেটির অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি এই সমস্যার সৃষ্টি করে। এছাড়াও, রুট ক্যানাল করার সময় ঠিকভাবে পরিষ্কার বা ডিসইনফেক্ট না করলেও সেটি থেকে সক্রমন হতে পারে। এটি নিজের থেকে ঠিক হয় না এবং চিকিৎসায় দেরি করলে সক্রমনের হার আরো বাড়তে থাকে।
১.এই সংক্রমনের প্রথম লক্ষণটি হলো তীব্র ব্যথা। এই ব্যথাটি সময়ের সাথে কমেনা, বরং বাড়তে থাকে। এই ব্যথাটি খাওয়ার সময় বা অন্য কোনো কারণে দাঁতের ওপর চাপ পড়লে বাড়তে থাকে।
২. দাঁতের পাশের মাড়ী ফুলে যায় এবং লাল হয়ে যায়। গুরুতর ক্ষেত্রে মুখ এবং গলা ও ফুলে ওঠে।
৩. সংক্রমনের জায়গা থেকে সবুজ, হলুদ বা সাদা রঙের পুঁজ নির্গত হতে থাকে
৪. মুখের মধ্যে বিস্বাদ এবং দুর্গন্ধ
এই রোগের চিকিৎসায় চিকিৎসক ডেন্টাল ড্রিল ব্যাবহার করে পুরনো রুট ফিলার ও ওষুধ গুলি বের করে ফেলেন এবং আবার নতুন করে ফিলিং করেন। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে এনামেলের কিছু অংশ বাদ দিয়ে পার্মানেন্ট ক্রাউন দিয়ে দেওয়া হয় যাতে ভবিষ্যতে এরকম সমস্যা আর না হয়। এছাড়াও ব্যাথা কমানোর জন্য ওষুধ এবং অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল ওষুধ ও ব্যাবহার করা হয়ে থাকে।
১. রুট ক্যানাল করার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফাইনাল ক্রাউন করিয়ে নিতে হবে
২. প্রতিদিন দুবার ব্রাশ, ফ্লস এবং অ্যান্টিসেপটিক মাউথওয়াশ ব্যাবহার করতে হবে
৩. ট্রিটমেন্টের পর চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ঠিক সময়ে ওষুধ খাওয়া
৪. কোনো রকম সংক্রমণের লক্ষণ দেখলেই তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া