ক্রনিক কিডনি ডিজিজ হলো কিডনির এমন একটি সমস্যা যেখানে কিডনি আস্তে আস্তে নিজের কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে থাকে। এর ফলে শরীরের দূষিত পদার্থ শরীর থেকে সম্পূর্ণ বের হতে পারেনা এবং শরীরে জমতে জমতে গুরুতর অবস্থার সৃষ্টি করে।
এই সমস্যাটি সাধারণত শুরু হয় শরীরে থাকা অন্য সমস্যা গুলি থেকে। যেমন যে সমস্ত ব্যাক্তির উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, গ্লোমেরুলো নেফ্রাইটিস, কিডনি তে সিস্ট ইত্যাদি সমস্যা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে কিডনি আসতে আসতে নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সব থেকে বেশি। এছাড়াও এই সমস্যা টির সাথে জেনেটিক্সের সম্পর্ক রয়েছে। পরিবারের কারো এই সমস্যা হয়ে থাকলে পরবর্তী জেনারেশন এর এই সমস্যা টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রথম ধাপে এই রোগের লক্ষণ একদমই বোঝা যায় না। এছাড়াও, লক্ষণ গুলি ক্রমাগত পরিবর্তন হতে থাকে। যে লক্ষণ গুলি সাধারনত দেখা যায় সেগুলি হলো,
১. খিদে, ঘুম এবং ওজন কমতে থাকা
২. হেঁচকি এবং অতিরিক্ত তৃষ্ণা
৩. সব সময় বমি বমি ভাব এবং বমি হওয়া
৪. অনিয়মিত প্রস্বাব হওয়া
৫. শারীরিক এবং মানসিক ভাবে দুর্বল অনুভব করা
৬. মাংস পেশী ক্ষয়ে যাওয়া এবং হাড়ে ব্যাথা
ক্রনিক কিডনি ডিজিজের সাধারনত কোনো চিকিৎসা নেই। প্রথম ধাপে ডাক্তার লক্ষণ গুলি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ঔষধ প্রয়োগ করে থাকেন এবং স্ট্রিক্ট ডায়েট দিয়ে থাকেন, তবে এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। রোগটি আরো গুরুতর হলে রোগী কে ডায়ালাইসিস করতে হয় এবং একদম শেষ পর্যায়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হয় ।
১. যে সমস্ত ব্যক্তির ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্ত চাপের সমস্যা রয়েছে, তাদের সময় মত মেডিসিন এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কিডনির পরীক্ষা করা বাধ্যতা মূলক।
২. পারিবারিক ইতিহাস থেকে থাকলে আগে থেকে পরীক্ষা করা উচিত এবং সাবধান থাকা উচিত
৩. একটি সঠিক ওজন ধরে রাখা এবং সাস্থ্য কর জীবন শৈলী মেনে চলা
৪. মদ্যপান এবং ধূমপান বর্জন
কিডনি স্টোন একটি বেদনাদায়ক রোগ, যা মহিলাদের তুলনায় পুরুষ দের মধ্যে বেশি দেখা যায়। কিডনি আমাদের শরীর থেকে দূষিত পদার্থ গুলিকে পরিষ্কার করে কিন্তু পরিশ্রুত করার সময় বেশ কিছু বস্তু যেমন ক্যালসিয়াম অক্সালেট, ক্যালসিয়াম ফসফেট, ইউরিক অ্যাসিড, সিস্টিন ইত্যাদি কিডনির মধ্যে জমতে জমতে শক্ত পাথরের আকার ধারণ করে।
যদিও কিডনি স্টোন এর নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই তবে কয়েকটি বিষয় রয়েছে যেগুলি কিডনি স্টোন তৈরি তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যেমন খুব কম পরিমাণে জল খাওয়া, অতিরিক্ত নুন এবং চিনি জাতীয় খাবার খাওয়া, ওবেসিটি, ওজন কমানোর অস্ত্র প্রচার ইত্যাদি । এছাড়াও পরিবারের কারোর কিডনি স্টোন হওয়ার ইতিহাস থাকলেও পরবর্তী জেনারেশনের সেটি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত ফ্রুকটোজ জাতীয় খাবার খেলেও কিডনি স্টোন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
১. লাল, গোলাপী বা বাদামি রঙের মূত্র
২. মূত্রত্যাগ করার সময় প্রবল যন্ত্রণা এবং ঠিকভাবে মূত্রত্যাগ না হওয়া
৩. পিঠের নিচের অংশ, দুই পাশ এবং তলপেটে বেদনা
৪.মূত্রের গন্ধের পরিবর্তন এবং অদ্ভুত দুর্গন্ধ যুক্ত মূত্র
কিডনি তে পাথরের আকার খুব ছোট হলে সেটি বের করার জন্য ডাক্তার ওষুধ এবং প্রচুর পরিমাণে জল পান করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। যদি পাথরের আকার অনেক বেশি হয় সেক্ষেত্রে কিছু উচ্চ মাত্রার ওষুধ ব্যাবহার করা হয় যা পাথর গুলি গলাতে সাহায্য করে। এছাড়াও বড়ো পাথর কিডনি থেকে বের করার জন্য অস্ত্রপ্রচারের ও সাহায্য নেওয়া হয়ে থাকে। এগুলি ছাড়াও আরো একটি চিকিৎসা পদ্ধতি হলো শক ওয়েভ থেরাপি যা পাথর গুলি কে ভেঙে ফেলে এবং মূত্রের সাথে শরীর থেকে বের করে দেয়।
১. প্রচুর পরিমাণে জল পান করা
২. নিয়মিত পরীক্ষা করে রক্তের মধ্যে ইউরিক অ্যাসিড ও অন্যান্য খনিজের উপস্থিতি নির্ধারণ করা
৩. বয়স এবং উচ্চতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে নিজের ওজন ধরে রাখা
কিডনি ইনফেকশন বা কিডনি তে সংক্রমণ হলো বাকটেরিয়ার উপস্থিতি, যা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় পাইলোনেফ্রাইটিস নামে পরিচিত। এই সংক্রমণ টি প্রথমে শুরু হয় ইউরিনারি ব্লাডারের মধ্যে এবং এর পর আস্তে আস্তে সংক্রমণ টি কিডনি তে ছড়িয়ে পড়ে।
কিডনি সংক্রমণের ঝুঁকি পুরুষ দের থেকে মহিলা দের বেশি হয়ে থাকে। মহিলাদের ইউরেথ্রাল ওপেনিং এর গঠন ব্যাকটেরিয়া, প্রধানত ই কোলাই কে, সহজেই ইউরিনারি ট্র্যাক্ট এর মধ্যে প্রবেশ করতে সাহায্য করে এবং সেখান থেকে সেটি কিডনি অব্দি পৌঁছে যায় ও সংক্রমণ সৃষ্টি করে। এছাড়াও গর্ভাবস্থায় এই রোগ টি হওয়ার সম্ভাবনা সব থেকে বেশি থাকে কারণ বাচ্চার উপস্থিতি মূত্র থলির মধ্যে চাপ সৃষ্টি করে এবং মূত্রের গতি অবরোধ করে। এছাড়াও কিডনি তে পাথর, প্রোস্টেট বৃদ্ধি, দুর্বল ইমিউন সিস্টেম ইত্যাদিও সংক্রমণ সৃষ্টি করে থাকে।
১. মূত্রের সাথে রক্ত এবং পুঁজ নির্গমন
২. বার বার মূত্র নির্গমনের ইচ্ছে এবং দুর্গন্ধ যুক্ত প্রস্বাব
৩.প্রস্বাব করার সময় জ্বালা এবং বাথ্যা
৪. তল পেটে এবং পিঠের দিকে প্রচন্ড পরিমাণে ব্যাথা হওয়া
৫. জ্বর এবং পেট খারাপ
এই রোগটি থেকে সুস্থ করে তুলতে ডাক্তার সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাবহার করে থাকেন এবং রোগের তীব্রতা অনুযায়ী এটির ডোজ ঠিক করা হয়। গুরুতর সংক্রমনের ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি করতে হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে ইন্ট্রাভেনাস মেডিসিন ব্যাবহার করা হয়। খুবই গুরুতর অবস্থার ক্ষেত্রে অস্ত্র প্রচার করতে হতে পারে তবে সেটি খুবই কম ক্ষেত্রে দেখা যায়।
১. মূত্র ত্যাগ করার পর উরেথ্রাল ওপেনিং টি ভালো করে পরিষ্কার করা এবং সাবান দিয়ে হাত ধোয়া
২. প্রচুর পরিমাণে জল পান করা
৩. মূত্রের বেগ পেলে বেগ চেপে না রাখা এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মূত্র ত্যাগ করা
৪. উরেথ্রাল ওপেনিং ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ডিওডোরান্ট এর ব্যাবহার বন্ধ করা
সিস্ট হলো ছোটো ছোট থলির মত বস্তু যেটির ভেতরে তরল পদার্থ ভর্তি থাকে। কিডনির মধ্যে সিস্ট বলতে বোঝায় এই তরল ভর্তি থলি গুলির উপস্থিতি। রোগের তীব্রতা অনুযায়ী সিস্ট দু ধরনের হতে পারে, পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম এবং সিম্পল সিস্ট।
ঠিক কি কারণে সিস্ট হয়ে থাকে তার নির্দিষ্ট কারণ এখনো পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে সম্ভাব্য কিছু কারণ চিকিৎসকরা খুঁজে বের করেছেন। তারমধ্যে প্রথম কারণ টি হলো ডাইভারটিকুলা, যেটি একটি থলির মত অংশ এবং এটির মধ্যে তরল পূর্ণ হয়ে গেলে এটি সিস্ট এর আকার ধারণ করে। এছাড়াও কিডনির মধ্যে কোনো টিউবিউল ব্লক হয়ে গেলে সেটি থেকেও সিস্ট তৈরি হয়। এই কারণ গুলি বাদ দিয়ে বয়স এবং পারিবারিক ইতিহাস এই রোগটি হওয়ার পেছনে গুরুতর ভূমিকা পালন করে থাকে।
১. প্রথম অবস্থায় সিস্ট এর উপস্থিতি একদম বোঝা যায় না, রোগটি একটু গুরুতর হলে মূত্রের সাথে রক্ত নিঃসৃত হতে থাকে
২. পিঠের দু পাশে যন্ত্রণা
৩. ব্লাড প্রেসার বৃদ্ধি পাওয়া
সিস্ট যদি ছোটো হয় এবং কোনো সমস্যার সৃষ্টি না করে তাহলে এটির জন্য কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু সিস্ট বড়ো হয়ে গেলে এবং বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিলে চিকিৎসকরা দু ধরনের চিকিৎসার সাহায্য নিয়ে থাকেন। প্রথমটি হলো সার্জারী, যেখানে সিস্ট টিকে অস্ত্র প্রচারের মাধ্যমে পুরোপুরি বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় উপায় টি হলো স্কেলেরো থেরাপি, যেখানে সিস্ট গুলিকে ফুটিয়ে তরল টি বের করে দেওয়া হয় এবং সিস্ট গুলি কে অ্যালকোহল দিয়ে পূর্ণ করে দেওয়া হয়, ফলে সেগুলি আর ভবিষ্যতে বাড়তে পারে না।
১. সারাদিন প্রচুর পরিমাণে জল খাওয়া
২. নুন জাতীয় খাবার কম খাওয়া এবং সারাদিন ২৩০০ mg এর বেশি সোডিয়াম না খাওয়া
৩. প্রসেসড ফুড, সফট ড্রিংক ইত্যাদি খাওয়া কম করা
৪. একটি সাস্থ্য কর জীবন যাপনের অভ্যেস গড়ে তোলা